একটি কাব্যগ্রন্থ এবং কিছু কথা
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৮ মার্চ, ২০১৫, ০৬:০৭:০৩ সন্ধ্যা
আমার সেই ছেলেবেলা থেকেই গল্প শুনতে ভালো লাগে। একটু বড় হবার পর থেকে গল্প পড়ার নেশা চাপে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত একটানা এই নেশায় নেশায় কেটে গেল অনেক বেলা।
কবিতা আমাকে তেমন ভাবে আকর্ষণ করত না। আসলে কবিতায় অল্প কথায় অনেক বিস্তৃত ভাবের প্রকাশ আমার মত নাদান পাঠকের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে বোধের অগম্য ছিল এবং আছে।
পড়ালেখার জন্য অনেক কবিতা মুখস্থ করতে হয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে আদতেই মনের নির্মল আনন্দ পেয়েছিলাম কি? রস আস্বাদন হয়েছিল কি? কিংবা সেরকম চাইতাম কিনা? আজ এতগুলো প্রশ্ন আমাকে কেন জানি ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। তবে সেই একেবারে ছেলেবেলায় নানার কাছে হাতে খড়ির পরে 'পাখি সব করে রব রাতি পোহাইলো' কিংবা 'সকালে উঠে আমি মনে মনে বলি' এ জাতীয় ছন্দময় পংক্তি আউড়ে যাবার ভিতরেও কেন জানি এক নির্মল আনন্দ লুকিয়ে ছিল। তবে তখন অনুভূতি অনুভূতির বাইরে ছিল বিধায় এখনকার মত আনন্দদায়ক অনুভূতির তীব্রতা ছিল না।
তখন ছন্দ ই ছিল কবিতার মূল অনুষঙ্গ... অন্ত্যমিল সম্পন্ন কবিতাগুলো ভালো লাগা এনে দিত। ছন্দের যাদুকর সত্যন্দ্রনাথ দত্তের-
'ছিপ খান তিন দাঁড়
তিন জন মাল্লা
চৌপর দিনভর
দেয় দূর পাল্লা' - এজাতীয় কবিতা পড়ায় বেশ আগ্রহ পেতাম।
এরপর একটু বড় হয়ে যতীন্দ্র মোহন বাগচির 'অন্ধ বঁধু' কবিতাটি পড়ি। এই কবিতায় একজন অন্ধ বউ যার স্বামী প্রবাসে- তার দৈনন্দিন জীবনের এক অনুপম বর্ণনা ফুটে উঠে এই কবিতাটিতে। মানে কবিতার ভিতরে লুক্কায়িত এক গল্পের সন্ধান পেলাম। ভালোলাগাগুলো সেই যে ঐ কবিতাটিকে ঘিরে হৃদয়ে বাসা বানালো, আজো সেই ভালো লাগার তীব্র এবং মোহনীয় আকর্ষণ মনের গভীরে রয়ে গেছে।
এখন বড় হয়েছি। বেশ বড়ই বলতে হবে। নিজে টুকটাক লিখছি... লিখার চেষ্টা করছি... অনুভূতিপ্রবণ হয়েছি। কিন্তু কবিতায় গল্প খোঁজার কিশোরবেলার সেই যে এক অভ্যাস তৈরী হয়েছিল, আজো তা পরিবর্তন হয়নি।
এবার বই মেলা থেকে মেঘ ফুলের স্টল থেকে এক রঙ্গা এক ঘুড়ি প্রকাশনীর বের করা কবি রুকসানা হকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ " মধ্যরাতের নদীর শব্দ" সাথে করে বাসায় ফিরেছিলাম। সর্বমোট ৭৩ টি কবিতা স্থান পেয়েছে এই কাব্যগ্রন্থটিতে। আমি এক একটি কবিতা পড়া শুরু করলাম... আর ... আমার সেই ছেলেবেলার সেই পরিচিত গল্পকে খুঁজে পেলাম কবির প্রতিটি কবিতা মাঝে!
এই লেখাটি কোনো 'বুক রিভিউ' নয়। এরকম একজন উঁচু মাপের কবির লেখায় সে ধৃষ্ঠতা প্রকাশ করাও আমার সাজে না। আমি শুধু আমার ভালো লাগার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চাইছি আমার আমিময় ভঙ্গিমায়। তবে এই কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে প্রাবন্ধিক এবং সাহিত্য সমালোচক জনাব মোহাম্মদ জমির হায়দার বাবলা তার যে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন সেটি না বললেই নয়। আমি হুবহু তার জবানীতে তুলে ধরছি-
" কোন কোন কবিতা পড়লে বিস্ময় জাগে তা হলো সেটা এই যে কবিতার সীমানা কোথায়। ইন্দ্রিয়ানুভূতির কত গভীর আর কত সংবেদনক্ষম হতে পারে। আবার কিছু কবিতা পড়লে গলা বুজে আসে। ব্যক্তি চেতনা সূক্ষ্ণতায় ক্ষুরধার হয়ে ভেদ করে সমষ্টি চেতনাকে। আর এড়িয়ে যাবার সুযোগ থাকেনা। চিরন্তনতা টলমল করছে এখানে। ব্যথা পাবার পর এক কেউ দাঁড়িয়ে আছে শূন্যতা বোধের ভেতর। অনন্ত কান্নার বোধে আক্রান্ত নিঃস্ব মানুষের উপলব্ধিতে সে যেন নিঝুম অশ্রুবিন্দুটি। আহা!
এ অবলোকনের খোঁজেই কবিরা ছুটে চলেছেন। প্রকৃতির আড়ালে কবিতা এভাবেই নির্মাণ করে চলেছেন নিজেদের বেদনার জগত। কবি তাঁর কবিতাতে একাকীত্বের সাথে যখন অনুভূতি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার সমন্বয় ঘটান, তখনই কবিতা আপন তন্ত্রীতে বেজে ওঠে। বিষাদ ও স্পর্শকাতরতা ধীরে ধীরে পাঠকের রক্তকণিকার ভেতর প্রবেশ করে পাঠককে উন্মাতাল করে। কবির একাকীত্ব স্পর্শ করে পাঠককে।
কবি রুকসানা হকের শব্দ প্রয়োগে জটিলতা নেই কিন্তু কারুকার্য কুশলতার ছাপ স্পষ্ট। তাছাড়া প্রতিটি কবিতায় কিছুটা গল্প রেখা মিলে তবে এ স্কেচ কোন ধারাবাহিক বর্ণনায় বর্ণময় হয়ে উঠে না। বরং অনেক কবিতাতে কাটা কাটা পৃথক বিবৃতি এবং চিত্রকল্পের আড়ালে একটা মুড এবং মুহুর্তের জন্ম দেয়। অনেক ক্ষেত্রে ছোট ছোট বুদ্ধিদীপ্ত বাক্যে অসমাপ্তি কিংবা সমাপ্তি তাঁর কবিতার আইডিয়াকে ফুটিয়ে তুলতে ভালোবাসেন। "
আমার মনে হয় এরপর আর কোনো কিছু বলার প্রয়োজন রাখে না এই কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে। এক নজরে এই কাব্যগ্রন্থটিঃ-
মধ্যরাতের নদীর শব্দ
রুকসানা হক
প্রকাশ কালঃ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
প্রচ্ছদঃ মোস্তাফিজ কারিগর
প্রকাশকঃ এক রঙ্গা এক ঘুড়ি
পরিবেশকঃ শ্রাবণ প্রকাশনী
মূল্যঃ ১৬৫ টাকা
৭৩ টি কবিতা সম্পর্কে আমার আলাদা আলাদা অনুভূতি ব্যক্ত করলে লেখাটির কলেবর অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। আমি কয়েকটি কবিতা থেকে আমার ভালো লাগার পংক্তিগুলো তুলে ধরছি... ...
' আমি ডুবেছিলাম মধ্যরাতের নদীর শব্দে
উঠে দাঁড়ানোর ইচ্ছেও ছিলনা,
অনাগ্রহ আর অবসাদে উপেক্ষা করেছি
ঝরা বকুলের তীব্র গন্ধ।
ভোরের দরোজায় ঝুলিয়ে রেখেছি মস্ত তালা
অনেক কাল থেকে সরের মতন নরম রোদ
ছড়ায় না আমার অভ্যস্ত নদীর জলে,
একটা প্রচ্ছন্ন মুখের প্রচ্ছদে আমি ভেসে বেড়াই।' [ মধ্যরাতের নদীর শব্দ ]
' তোমাকে রাখতে চাই না মেঘ ভালবাসায় খোদার কসম,
স্নানের শেষে ভেজা চুলে যদিও বা লেগে থাকে
তোমার চোখের কাঁপন, তবুও
রাখতে চাই না তোমায় জল করে চুলের ভেতর।
স্মৃতির মত করে তোমাকে ঘাটতে চাই না আর
তুমি না হয় থাকলে আমার একচিলতে দুঃখময় আকাশ হয়ে। ' [ দুঃখময় আকাশ ]
' চোখ খোল-- চেয়ে দেখো রুপোর কৌটো খুলে--
আমি সেখানেই আছি
অনুবাদ করো -- দেখো আমি কতটা নিপুণ
ছুঁয়ে দেখো জোনাকীর মুখ
আমি সেখানেই নীল হয়ে ডুবে আছি
কতটা নীল মাপতে চাও? ' [ মোমের বাগান ]
' অন্ধকারে শামুকের গুটানো শরীর যদি স্পর্শ করে
বালিকার মসৃণ বালুচর,
চরে জমা হবে সবখানি ঘৃণার বাতাস
দারুন ব্যথায় জেগে উঠবে বিস্মিত পাথরের বুক। ' [ তির্যক বালিকার চোখে ]
' ধরো তোমার এক একটা অসম্ভব স্পর্শ বাক্য হলো,
শব্দহীন ছন্দ হলো ওষ্ঠের তৃষ্ণা তোমার
আমার আয়ু থেকে পঁচিশটি বছর
আমি তোমাকে উপহার দেবো শর্তবিহীন। ' [ অবাক সন্ধ্যা ]
' ভালোনাসার অবসরে
আমি দিগন্তের ক'গাছি স্বপ্ন ছুঁয়েছি,
খুব যত্ন করে আমার যে সকালটা রেখেছি
ভোরের কালো পাড় শাড়ির ভাঁজে,
সেখানে বৃষ্টিরা টুপটাপ চিঠি লিখেছে।
অক্ষরের ছন্দে ছন্দে
তুমি জেগে উঠেছো প্রদীপের মত
আমার বারোমাসি প্রার্থনায় সিক্ত হয়ে।' [ ভালোবাসার অবসরে ]
' শবঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকো কুয়াশার মত
বেহায়া বাতাসের স্পর্শে মলিন করো না দেয়ালের গা,
আমার মৃত্যুর তৃতীয় মিনিটেই এসো এই ঘরে
তোমার নিঃসাড় বক্ষ হোক আমার অনন্ত বাস। ' [ শবঘরের দেয়াল ]
প্রতিটি কবিতাই এক নান্দনিল কথামালায় হৃদয়কে দ্রবীভূত করে... ভালোলাগারা সিক্ত হয় অনাবিল সুখের স্ফুটনে। এই কাব্যগ্রন্থটি আমাকে নতুন করে কবিতার প্রতি ভালোলাগায় আদ্র করেছে। অনেক ধন্যবাদ কবি এমন সুন্দর কিছু অনুভূতি পাঠকদেরকে উপহার দেবার জন্য।
ভালো থাকুন সবসময়... অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
বিষয়: বিবিধ
১৫০৫ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
হ্যা, মুছে দিয়েছি বাড়তি অংশ টুকু।
আমার ব্লগে স্বাগত!
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া ।
আসলেই এই কবি দুর্দান্ত লিখেন। বইটি উপহার দেবার জন্য 'একজনকে' অনেক ভালো হবে।
ভালো থাকুন।
আসলেই বইটি দুর্দান্ত। শব্দ চয়নে এতো নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন যে আমি অবাক হয়েছি প্রতিটি কবিতা পড়ার সময়ে।
ভালো থাকুন।
শুকরিয়া আপনাকে শেয়ার করার জন্য
আমিও তাল হারিয়ে ফেলি।
সুন্দর অনুভূতি রেখে যাবার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
ভালো থাকুন।
লেখটি ভালো লাগলো।
আমি ডায়েরি নিয়ে একটি লিখা শেষ করতে পারছি না, ঝামেলায় আটকে গেছি। কিছু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। ইনশা আল্লাহ দ্রুতই নিয়মিত হবো।
ভালো লাগার অনুভূতি রকেহে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন